শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (ষষ্ঠ পর্ব) / ড. মোহাম্মদআমীন


খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক হতে আরবীয় বণিকেরা ব্যবসায় বাণিজ্য উপলক্ষে এবং মুসলিম ধর্ম প্রচারকেরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পতেঙ্গা এবং সংলগ্ন উপকূল বেয়ে চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম আগমন করে। তাদের একটি প্রভাবশালী অংশ দোহাজারীতে শঙ্খ নদীর তীরে ছোটখাটো একটি গঞ্জ গড়ে তোলে। তাই
বলা যায়, দোহাজারীই চন্দনাইশের প্রথম পরিকল্পিত আধুনিক গঞ্জ। চন্দনাইশে বসতি স্থাপনকারী আরব বণিক, নাবিক, ফকির দরবেশ এবং গৌড়ের তুর্কী পাঠান বাদশাহদের গৌড়াগত মুসলমানদের সাথে স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ প্রমূখ ধর্মাবলম্বীদের সংমিশ্রণ ও ধর্মান্তরের ফলে চন্দনাইশে সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এ সময় উচচ বর্ণের হিন্দুরা সমতটসহ অন্যান্য এলাকা হতে চন্দনাইশ  এসে বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। 
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে চন্দনাইশের জনগোষ্ঠীতে আর একটি নতুন ধারার মিশ্রায়ন শুরু হয়। এসময় ইউরোপ হতে পতুর্গিজ নাগরিকেরা চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে চন্দনাইশ আসতে শুরু করে। চন্দনাইশে বসবাসকারী পুর্তগিজ নাবিক ও জলদস্যুদের ঔরসে এবং নিুবর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধ রমণীর গর্ভে কিছু নি¤œ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তারা ফিরিঙ্গি নামে পরিচিতি পায়। ফলে চন্দনাইশ এলাকা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও মেটে ফিরিঙ্গি অধিবাসীদের আবাসভূমিরূপে গড়ে উঠে।  হিন্দু গোত্রীয় আর্যদের মধ্যে প্রথমে ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধারা খ্রিস্ট পূর্ব ৬০০ অব্দে চন্দনাইশ  আগমন করেছিল। বৈশ্য বা ভেষজ গোত্র এবং সবশেষে ব্রাহ্মণেরা চন্দনাইশ  আসে। নোয়াখালীর ঋূগ্যমুখ, বীরকোট, ভরতপুর, হনুবিশ, কুমিল্লার গোমতি, চট্টগ্রামের সীতাকু-, বাড়বকু-, চন্দ্রনাথ, আদিনাথ, রামচরণ, রামু, রামপুর, লক্ষিদিয়া, প্রভৃতি চন্দনাইশ  এবং তৎসংবর্তী এলাকাসমূহে আর্য আগমন ও প্রভাবের প্রমাণ বহন করে।  
নবম শতক হতে চন্দনাইশে মানব বসতির বর্তমান পর্যায়ের শুরু হয়। চন্দনাইশের মূল ও আদিবাসীরা এখন বিলুপ্ত। তাহলে বর্তমান অধিবাসীদের উৎস বা উৎপত্তি কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর সাম্প্রতিক কালের জন-স্থানান্তর ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে চন্দনাইশে আরবীয় বণিকদের প্রভাব পড়তে শুরু করে। মুতা বিয়ের ফলে উপকূলীয় এলাকায় আগত ও স্বল্প অবস্থানকারী আরব বণিকদের দ্বারা অনুস্বরিত আরব- 
চন্দনাইশি রক্তের সংশ্রবে নতুন বংশধারা সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটে।  আরবীয়দের প্রভাব নানা কারণে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অবশ্য তখনও হিন্দুদের প্রভাব ছিল প্রবল। চট্টগ্রামে পাঠানদের শাসনামলে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ চন্দনাইশ এলাকায় পাঠান রক্তের প্রবাহ শুরু হয়। পরবর্তীকালে পাঠান শাসিত এলাকা হতে আগত বহু পাঠান চন্দনাইশে সপরিবারে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। আবার এদের অনেকে এখানকার স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সংসার পেতে বংশ বৃদ্ধি করে। প্রথমে তাদের বিয়ের জন্য মহিলা পেতে কষ্ট হয়েছিল। তবে তারা বিধবাসহ নানা নি¤œশ্রেণির মহিলাদের বিয়েতেও আগ্রহ ছিল। ফলে চন্দনাইশ র অধিবাসীদের মাঝে বিভিন্ন উপায়ে পাঠান, মোগল ও আরব রক্ত মিশে যায়। 
একাদশ শতকে বহু আরবীয় বণিক চন্দনাইশে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছিল বলে জানা যায়। এজন্য চন্দনাইশ বাসীদের মধ্যে আরবীয় রক্তের স্রোত বহু পূর্ব হতে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রকৃতিগত কারণে চন্দনাইশ  তার ভূমিতে আরবীয় রক্তের ধারাবাহী জনগোষ্ঠী লালন করছে। লবণাক্তবায়ুর সঙ্গে পাহাড়ি আবহাওয়ার মিশ্রণের কারণে চন্দনাইশের লোকজনকে তুলনামূলকভাবে কালো দেখালেও আরবীয়দের মত উন্নত নাসা-গন্ডাস্থি, সুচালো-সুচক্র নাক, অপরিসর বদন ও গৌরকান্তি চেহারার অনেক লোক চন্দনাইশে আরবীয় রক্তপ্রবাহের ইঙ্গিত দেয়। চন্দনাইশের বহুল ব্যবহৃত আরবি-উর্দু-ফার্সি ইত্যাদি শব্দ যথা : কুত্তা, হাউয়া, আইব (কুৎসা), সিদ্দত (কষ্ট), মঙ্গা (মহার্ঘ)  ইত্যাদি চন্দনাইশবাসীর মোগল-আরবীয় রক্তের মিশ্রণের স্বাক্ষর বহন করে। 
           সূত্র. মোহাম্মদ আমীনচন্দনাইশের ইতিহাস,  দ্বিতীয় অধ্যায়
[ এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন