শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (প্রথম পর্ব) / ড. মোহাম্মদ আমীন

চন্দনাইশ এর প্রাচীনত্ব /১
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ( দেখুন : চন্দনাইশের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়, চন্দনাইশের প্রাচীনত্ব) কমপক্ষে ৫০ হাজার বছর আগে চন্দনাইশের উৎপত্তি হয়েছে। অন্যদিকে ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণে আনুমানিক ৮/১০ হাজার বছর পূর্বে এখানে নব্যপ্রস্তর যুগের ‘হোমোসেপিয়েন্স’ বা আধুনিক মানব প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল
বলে জানা যায়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শনসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক গবেষকগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাঁদের গবেষণামতে আজ হতে ৫০ হাজার বছর আগে সর্বপ্রথম উচ্চ-প্রস্তর যুগের মাগদালীয়, সলুত্রীয় কিংবা উরিগনসীয় সংস্কৃতির ‘হোমোসপিয়েন্স ফসিলিস বা ক্রোমানীয়’ প্রজাতির মানুষ চন্দনাই অঞ্চলে আগমন করেছে ধারণা করা অবাস্তব নয়। সে হিসাবে অন্তত ৪০/৫০ হাজার বছর আগে চন্দনাইশে উচ্চ-প্রস্তর যুগের মানুষের বসবাস ছিল বলে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা। আলোচ্য ভূমি-সৃষ্টির প্রারম্ভ হতে আনুমানিক ১০ হাজার বছরব্যাপী চন্দনাইশ  এবং সংলগ্ন এলাকাসমূহের বৃহদংশ গভীর অরণ্য এবং মানব বসতিবিহীন শ্বাপদ জন্তুর অভয়ারণ্য ছিল। বর্তমানে চন্দনাইশ নামে পরিচিত জনবহুল এ ভূ-খ-টি তখন মহাবিশ্বের অনাবিষ্কৃত কোনো গ্রহের ন্যায় নাম-গোত্রহীন অবস্থানের একটি পরিত্যক্ত অরণ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না।  
নামহীন সবুজ অরণ্যম-িত ‘গহীন-সবুজ’ চন্দনাইশ সমৃদ্ধ অঞ্চল দীর্ঘ ১০ হাজার বছর ছিল শ্বাপদ জন্তুর নিরাপদ আস্তানা। আজ হতে ৫০ হাজার বছর পূর্বে এখানে উচ্চপ্রস্তর যুগের মানব বসতির পদ বিন্যাসের সূচনা ঘটে।  লক্ষাধিক বছরের বৃক্ষাদিতে সমৃদ্ধ অথচ মনুষ্যবিহীন চন্দনাইশ মানুষের কাকলিতে ধীরে ধীরে মুখরিত হবার পালা শুরু হয় ৫০ হাজার বছর পূর্ব হতে। বৃক্ষ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক স¤পদের প্রাচুর্যতার কারণে আর্য সভ্যতা শুরু হওয়ার অন্তত সনশ বছর পূর্বে এখানে বিশ্বখ্যাত জাহাজ নির্মাণ এবং কাষ্ঠ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। চন্দনইরশর কাষ্ঠ এবং কাষ্ঠ নির্মিত দ্রব্যাদি সুদুর চীন পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কাজের তাগিদে পার্শ্ববতী এলাকা তথা বর্তমান বাঁশখালী, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম, সাতকানিয়া প্রভৃতি এলাকা হতে মানুষেরা এসে  চন্দনাইশে আধুনিক বসতি গড়ে তুলে। 
শুধু অবস্থানগত বিন্যাসের কারণে বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগে¦দে চন্দনাইশ, এমনকি চট্টগ্রাম সম্পর্কে কোনো বিবরণ নেই। মনুসংহিতাতেও গঙ্গার পূর্ব-দক্ষিণের জনপদের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, অনার্য তিব্বতীয়-ব্রহ্মদের ‘কিরাত ভূমি’ ছাড়া দক্ষিণ বঙ্গের অধিকাংশ স্থান তখনও সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত ছিল। কিন্তু চন্দনাইশের অখিকাংশ এলাকা তখন পরিপূর্ণ একটি ভূ-খ-। ওয়েবষ্ঠার সম্পাদিত নোয়াখালী গেজেটিয়ারের ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, "This district (Noakhali) most Probably became fit for human habitation during the period of the vedas (1400-1000 B.C), অর্থাৎ ঋগে¦দ যুগের পূর্বে নোয়াখালী তথা চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটি মানব বসতির উপযোগী হয়ে উঠেছিল। সে হিসাবে চন্দনাইশ এলাকায় খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার বছর পূর্বে গোলমাথা বিশিষ্ট মানবের বসতি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। তা সত্য হলে ৪০/৪৫ হাজার বছর পূর্বেকার মধ্য-প্রস্তর যুগের অধিবাসীরাও চন্দনাইশে বসবাস করত বলা যায়। 
আলোচনার সুবিধার্থে চন্দনাইশে মানব বসতির প্রারম্ভকাল হতে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত মানব বসতির পর্যায়কে (১) সূচনা পর্যায় (২) দ্বিতীয় পর্যায়  (৩) তৃতীয় পর্যায় (৪) আধুনিক পর্যায় এবং (৫) বর্তমান পর্যায়- এ ৫টি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য মানুষের উৎপত্তি, সময়কাল, আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য, জীবনধারা, অভিবাসন, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো পর্যায় বিভক্তিতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। 
খৃস্টপূর্ব ৫০,০০০ অব্দ হতে খৃস্টপূর্ব ৫,০০০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত পরিধিকালকে চন্দনাইশের মানববসতির সূচনা পর্ব অভিহিত করা যায়। এ পর্যায়ে চন্দনাইশে মানুষের প্রথম আগমন ঘটে। এর পূর্বে এখানে মানুষের কোনো পদচিহ্ন পরেনি। এ পর্যায়ের প্রথমদিকে বর্তমানে  চন্দনাইশ ও পটিয়া নামে পরিচিত ভূ-খ-টিতে উচ্চ-প্রাচীন তথা মধ্য-প্রস্তর যুগ কিংবা নব্যপ্রস্তর যুগের মানব বসতির আগমন ঘটেছিল। প্রারম্ভ পর্যায়কে মানব আগমনের প্রকৃতি বিবেচনায় দুটি উপ পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা : মধ্যপ্রস্তর যুগ এবং নব্যপ্রস্তর যুগ। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ হাজার অব্দ হতে ১০ হাজার অব্দ পর্যন্ত মধ্য প্রস্তর যুগ এবং খৃস্টপূর্ব ১০ হাজার অব্দ হতে ৫ হাজার অব্দ পর্যন্ত নব্যপ্রস্তর যুগ। 
প্রারম্ভ পর্যায়ের প্রথমার্ধে তথা মধ্যপ্রস্তর যুগে আসাম, বার্মা, চীন, নেপাল, নাগাল্যান্ড, দক্ষিণ আরব, তিব্বত প্রভৃতি এলাকার মত চন্দনাইশেও গোলমাথা বিশিষ্ট উচচপ্রস্তর (মধ্যপ্রস্তর) যুগের মানবগোষ্ঠীর অস্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। সীতাকুন্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আমাদের এটাই ইঙ্গিত দেয়।  বান্দরবান পার্বত্য এলাকা হতে শঙ্খ নদী পার হয়ে গোলমাথা বিশিষ্ট জনগোষ্ঠী এবং  নেপাল-বার্মা হয়ে নাফ নদীর পথ বেয়ে সুদুর চীনা-তিব্বতি আদি পর্যায়ভূক্ত মানবগোষ্ঠী  শঙ্খনদী বেয়ে চন্দনাইশের উর্বর অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছিল। এখানে বসবাস শুরু করার  পেছনে যথেষ্ট যুক্তি এবং কারণও ছিল। জীবনধারণের পরিবেশগত সুবিধা বিবেচনায় চন্দনাইশ  অতি প্রাচীন কাল হতে মানব বসতি গড়ে তোলার নানা উপাদানে পূর্ণ একটি আদর্শ স্থান রূপে বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় কিংবা অ-উপকূলীয় বা অন্যান্য সমতল এলাকাগুলো হতে চন্দনাইশ জেলার ব্যাপক স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। চন্দনাইশের একদিকে পাহাড় অন্যদিকে নদী। এটা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্যজেলাসমূহের প্রায় মধ্যবিন্দু হিসাবে তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশ্রামস্থল। এখানে পাওয়া যেত প্রচুর মাছ, বৃক্ষ, উর্বর ভূমি। প্রচুর প্রাকৃতিকসম্পদসহ ভৌগলিক সুবিধা চন্দনাইশকে মনুষ্য বসবাসের আদর্শ স্থানে পরিণত করে তুলেছিল। চানখালী ও শঙ্খ নদী বিধৌত উর্বর ভূমি সুদুর অতীতকালেও আদিম মানুষদের টেনে এনেছে চন্দনাইশে।  
খাদ্য, পানি এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রাচীনকালে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীসমূহ সমতল এলাকা সমন্বিত পাহাড়ি এলাকা বা পাহাড়ি এলাকার নিকটবর্তী অনুচ্চ পর্বতের সমতল এলাকা-  যেখানে মিষ্টি পানির সুলভতা বা বিশুদ্ধ পানির ছোট নদী প্রবাহিত হতো সেখানে বসতি গড়ে তুলত। যাযাবর শ্রেণীর প্রাচীন জনগোষ্ঠীরা  হন্যে হয়ে অনুরূপ জায়গা খুঁজে বেড়াত। চাষাবাসের সঙ্গে পরিচিত হবার পর পাহাড়ের চেয়ে নদী তীর সংলগ্ন কিছুটা উঁচু কিন্তু উর্বর ভূমিই তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। কিন্তু চাষাবাদের সাথে পরিচিত হয়ে উঠলেও প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিজদ্রব্য উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক অসুবিধার কারণে শুধু কৃষিকাজ বা চাষাবাদ জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত মাত্রায় সন্তোষজনক ছিল না। অধিকন্তু একাধিক বার ব্যবহারে জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে যেত। সার প্রয়োগ বা উর্বরতা বৃদ্ধির কোনো কৌশল তখনো তাদের আয়ত্বে ছিল না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে পুরাতন স্থান ত্যাগ করে অন্যকোনো উর্বর সুবিধাজনক স্থানে চলে যেত। 
খুবই সীমিত এবং অপর্যাপ্ত মাত্রার কৃষি ধারণার কারণে প্রাচীন জনগোষ্ঠীদেরকে খাদ্যের জন্য প্রকৃতির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল থাকতে হতো। সংগতকারণে তারা পাহাড়ের নির্ভরশীলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারত না। এমনকি বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ পাহাড়ের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। তাই জীবনের জন্যই প্রাচীন জাতি বা উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত জনগণ এক স্থান হতে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াত এবং সুবিধাজনক স্থানে নিজেদের বসত গড়ে তুলত। যেখানে পাহাড়ীয় সমতল এলাকা এবং নদীর অবস্থান পাশাপাশি ছিল সে সমস্ত এলাকা খুজে বের করে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসতি গড়ে তুলত। নিরাপদ পাহাড়ের সঙ্গে সমতল এলাকা, ছোট নদী, উর্বর ভূমি এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় সুদুর ৫০ হাজার বছর আগের জনগোষ্ঠীর বসতি গড়ে তোলার প্রকৃতি বিবেচনায় চন্দনাইশ  ছিল এই এলাকার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। বিশেষ করে তৎকালে অত্যাবশ্যকীয় অর্থকর দ্রব্য গাছের প্রাচুর্য এবং জলযান নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাষ্ঠ প্রাচীন কালেও চন্দনাইশকে বসতায়নের আদর্শ স্থানে পরিণত করেছিল। তাই সীতাকুণ্ড, আসাম, চীন, তিব্বত, নেপাল, বার্মা প্রভৃতি এলাকা হতে বহু গোলমাথা বিশিষ্ট লোক খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার বছর পূর্ব হতে চন্দনাইশের উর্বর মাটিতে বসতি গড়ে তোলার জন্য ভীড় জমিয়েছিল। এজন্য চন্দনাইশের অভিজাত অংশে গোলমাথাবিশিষ্ট লোকের আধিক্য দেখা যায়। চানখালী  ও শঙ্খ বা সাঙ্গু নদীর উর্বর পলি এবং অপেক্ষাকৃত কম সংহারি বন্যার কারণে চন্দনাইশে বসতিস্থাপনকারী আদি জনগোষ্ঠীর যাযাবর স্বভাবকে বহুলাংশে কমিয়ে আনে এবং তারা অনেকটা স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে চন্দনাইশ এলাকায় বসবাস শুরু করে।
          সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, চন্দনাইশের ইতিহাস,  দ্বিতীয় অধ্যায়।
[ এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। এ লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় ও চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন