সার্বিক বিশ্লেষণে নৃতাত্ত্বিক অনুভবে মধ্য এশিয়ার কুপণু, শক, হুন, সিথিয়, পার্থিয়, আরব-ইরানি, উত্তর-আফ্রিকান নিগ্রো কিংবা ইউরোপীয়ানদের রক্তও বর্তমান চন্দনাইশের কোনো কোনো অধিবাসীর দেহে বয়ে যাচেছ বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। সমতট এলাকার মুচি, মেথর, হাড়ি, ডোম, চাঁড়াল, বাগদি, কৈবর্ত নামের অ¯পৃশ্য ও নিচু জাতের জনগণও কিন্তু অস্ট্রিক-ভেড্ডিড-আল্পীয়দের শংকর বংশধর বা
উপজাতি। যা এখনো চন্দনাইশে আছে। শর্ট হেডেড মঙ্গোলীয়, কিরাত, মলঙ্গি ও হালিয়াদাসের পর চন্দনাইশের অধিবাসীদের সিংহভাগই আরাকান এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, সীতাকু- প্রভৃতি এলাকা হতে আগত। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশ কিছু অধিবাসী আরাকানি রোহিঙ্গা হলেও তারা ক্রমান্বয়ে মুল বাংলাদেশীয় সভ্যতা ও কৃষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছে। তাই এলাকাসমূহের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোচ্য প্রেক্ষাফটে চন্দনাইশের অধিবাসীরাও মূল-ভূখ-ের সম-প্রকৃতি ও সমরূপি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যেসমূহ অর্জন করে নিয়েছে। পাশ্ববর্তী উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা হতে আগত লোকদের রক্তে মগ-পতুর্গিজ-আরবীয়-পাঠান-মোগল প্রভৃতি রক্তের অবস্থান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ইত্যাদি বিবেচনায় চন্দনাইশের অধিবাসীদের অষ্ট্রো-মঙ্গোলীয় বলে নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়। আরও সু¯পষ্ঠভাবে বললে চন্দনাইশের অধিবাসীদের অষ্ট্রো-মঙ্গোলীয় রক্তের সঙ্গে বর্ণিত ভিন্ন জাতীয় রক্তের একটি অনন্য শংকর বলা যায়।চন্দনাইশ র মানুষ এবং মানুষের প্রকৃতি নিয়ে কখনো কোন গবেষণা হয়নি। তাই এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও ধারণা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। চন্দনাইশের মানুষের মধ্যে যেসব মানব ধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তাদের মধ্যে প্রোট-অষ্ট্রালয়েড ও আলপাইন
মানবধারার প্রভাব সমধিক উল্লেখযোগ্য। এরপর আসে মঙ্গোলীয় মানবধারার কথা। তবে গুহ এবং অন্যান্য গবেষকদের অভিমতের প্রাসঙ্গিকতা টেনে বলা যায়, এখানে মঙ্গোলীয় মানবগোষ্ঠীর প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়। কারণ চন্দনাইশ এলাকার অধিকাংশ মানুষের মুখে দাড়ি গোফ গজায়। যা মঙ্গোলীয় মানবগোষ্ঠির বৈশিষ্ট্যের প্রতিকূল। এখানকার মানুষের চোখের উপরের পাতায় মোঙ্গলীয় বৈশিষ্ট্যসূচক ভাঁজ দেখা যায় না। তাদের মুখম-ল মঙ্গোলীয়দের মতো অত সমতলও নয়। নাকের গোড়া অক্ষিকোটরের সমতল থেকে সাধারণত যথেষ্ট উঁচু হয়ে থাকে। এ এলাকার মানুষের মধ্যে নিগ্রোবিটু প্রভাব যদি কিছু থেকেই থাকে তবে তা খুব সামান্যই পরিদৃষ্ট। সুন্দরবনের জেলে সম্প্রদায় যশোর অঞ্চলের বাঁশফোড়দের মধ্যে কিছু কিছু নিগ্রো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
লেখকের পিতামহ আহমদ হোসেন ও প্রধানমন্ত্রী হর্নলেগ্রিয়ারসন এর ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্বের ভিত্তিতে রমাপ্রসাদ চন্দ্রের অভিমতের পরিবিশ্লেষণ করে বলা যায়, “চন্দনাইশের মানুষের মধ্যে গোলমাথার প্রাধান্যের কারণে আলপাইন মানবধারার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়।” রমাপ্রসাদ চন্দ্রের মতে “বাংলা ভাষা অবৈদিক আর্য ভাষা এবং অবৈদিক আর্যরা ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের দিকে মধ্য এশিয়া হতে আগত আলপাইন মানবধারার লোক।” উল্লেখ্য গালিচা, তাজিক ইত্যাদি জনগোষ্ঠিসহ গোলমাথার অধিকাংশ লোকই আলপাইন মানবধারভূক্ত জনগোষ্ঠী। চন্দনাইশের বর্তমান মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো আরবীয় কিংবা মোগল পাঠান বংশজাত। এরা অভিজাত মর্মে পরিচিত এবং এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী অধিবাসীদের মধ্যে মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যের চেয়ে আরব-মোগল-বৈশিষ্ট্য সমধিক লক্ষণীয়।বর্তমানে এ সকল গোষ্ঠীর মানুষকে আলপাইন মানবধারার লোক বলে গণ্য করা যায় না। পরিবর্তন-পরিবর্ধণে অনুরূপ কোনো উপাদান এখন তেমন সাধারণ চোখে বুঝা যায় না। এরা এখন স্বতন্ত্র মানবধারায় চিহ্নিত হয়ে আসছে, যাদেরকে নৃবিজ্ঞানীগণ সাধারণত তুরানি বলে চিহ্নিত করে থাকেন। এরমধ্যে আলপাইন ও মঙ্গোলয়েড উভয়বিধ মানবধারার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য
একত্রে পরিদৃষ্ট। কোনো কোনো গবেষকদের মতে তুরানি মানবধারা থেকে অতীতে একাধারে আলপাইন এবং অন্যদিকে মোঙ্গলীয় মানবধারার উৎপত্তি ঘটেছে। উপমহাদেশসহ চন্দনাইশ অঞ্চলে আগত মুসলমান তুর্কি বিজেতারাও প্রধানত তুরানি জনগোষ্ঠীভুক্ত লোক। তবে তাদের আচরণ ও অবয়বে মোঙ্গলীয় জনগোষ্ঠির বৈশিষ্ট্য সমধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মোগলবাহিনী উত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল দখল করে। মোর্তজা খাঁর নেতৃত্বে এরা কর্ণফুলি নদী পার হয়ে শঙ্খ নদীর উত্তর তীরে এসে অবস্থান নেয়। আধু খাঁ, লক্ষ্মণ সিংহ ও দুজন হাজারী মনসবদারকে সেখানকার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে, চন্দনাইশবাসীর অনেকের রক্তে প্রবাহিত হয় মোগল রক্ত।ত্রয়োদশ শততে মালয় ও ইন্দোনেশিয়ায় দলে দলে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পুরো উপমহাদেশে অনুরূপ ঢেউ এসে লাগে চন্দনাইশে। ইসলামের প্রবল আকর্ষণে চন্দনাইশ ও প্লাবিত হয়। হাজার হাজার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। স্বল্প সময়ের মধ্যে চন্দনাইশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে যায়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে চন্দনাইশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল মুসলমানের চেয়ে অধিক। কিন্তু ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে চন্দনাইশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেড়ে যায়। এরপর হতে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশ আরও দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। তবে লক্ষণীয় যে, মুসলিম বৃদ্ধির ইতিহাস হলো ইংরেজ আমলের ইতিহাস, মুসলিম আমলের ইতিহাস নয়। বর্তমানে চন্দনাইশের মোট জননসংখ্যা ১৯২৬০০; তন্মধ্যে পুরুষ ৯৮২৭০, মহিলা ৯৪৩৩০। মুসলিম ১৬১৭৫১, হিন্দু ২৫৫০০, বৌদ্ধ ১৪২, খ্রিস্টান ৫১৫৭ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ৫০।
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, চন্দনাইশের ইতিহাস, দ্বিতীয় অধ্যায়।
[ এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। এ লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় ও চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]
শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬
চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (অষ্টম পর্ব) / ড. মোহাম্মদ আমীন
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন