শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (চতুর্থ পর্ব) / ড. মোহাম্মদ আমীন


এরপর মেডিটেরিয়ান দ্রাবিড়েরা চন্দনাইশ আসে। উপমহাদেশের সুপ্রাচীন মোহনজদারো এবং হরপ্পা সভ্যতা মেডিটেরিয়ানদেরই অবদান। আর্যরা তাদেরকে দস্যু এবং দাস বলে জানত। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শিব-উমা, যোগতত্ত্ব, মন্দির উপাসনা, নারী-দেবতা, জন্মান্তর তত্ত্ব, প্রতিমা, পূজা, বৈরাগ্য, বৃক্ষপূজা, পশুপাখির পূজা প্রভৃতি এদের থেকে হিন্দু এবং বৌদ্ধরা প্রাপ্ত হয়েছে। আর্য নামে অভিহিত প্রথম প্রবাহের আলপাইনীয়রা গুজরাট, মারাঠা প্রভৃতি short headed Mongoloid  জনগোষ্ঠীর লোকেরা বার্মা হয়ে আরাকান, চন্দনাইশ  ও চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে এরাই চন্দনাইশের মূল জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিণত হয়। অনরহটার আমলে পগাঁ (পুকম, অরিমর্দণপুর) ও পাট্টিকেরা রাজ্যের মধ্যে গভীর রাষ্ট্রীয় সখ্যতা ছিল। এ সখ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে, এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ থেকে যায় যে, ভোট চীনা গোত্রের লোকেরা কাছাড় হতে বার্মা অবধি বিস্তৃত হয়ে চন্দনাইশ  অঞ্চলে ব্যাপক নিবাস ও প্রসার গড়ে তোলেছিল। 
অঞ্চল হতে বাংলাদেশে, পার্বত্য এলাকা, চট্টগ্রাম এবং চন্দনাইশে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় প্রবাহে আর্যভাষী নর্ডিকরা উপমহাদেশে প্রবেশ করলেও উত্তর ভারতে থেকে যায়। তৃতীয় পর্যায়ে 
চন্দনাইশে বর্তমানে বসবাসরত বুড্ডিস্ট, অন্যান্য উপজাতি, বিশেষ করে চন্দনাইশ বান্দরবান সীমান্তে বসবাসরত মগ, চাকমা, খুকি, উসাই, লুসাই, মারমা প্রভৃতি তাদের উত্তর পুরুষ। চন্দনাইশে ব্যবহৃত ভাষার ধ্বনি-বিকৃতি ও শাব্দিক উচচারণ প্রক্রিয়ায় ভোট চীনার প্রভাব এখনও ¯পষ্ঠ লক্ষণীয়। অনেকে মনে করেন, দাক্ষিণাত্যের  তেলংগ উদ্ভুত আসামের খাসি এবং বার্মার মম বা  টালাইং  শ্রেণির অস্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠীই সম্ভবত চন্দনাইশে প্রথম আদিবাসী। যাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে কুমিল্লা নোয়াখালী তথা সমতট হতে ভোটচীনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে কুকি-চীনাগণ এসে চন্দনাইশের জনগণের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীকালে ১১শ শতকের দিকে বার্মার মার্মা গোষ্ঠীর লোকেরা আরাকানে অনুপ্রবেশ করে।  এবং সেখান হতে চন্দনাইশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
চন্দনাইশের তৎকালীন বাণিজ্য ক্ষেত্র, গঞ্জ কিংবা শহর এলাকাগুলোতে মলঙ্গিদের একক প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল।  কারণ লবণ ও চন্দন ব্যবসা একছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। অধিকন্তু চন্দনাইশ বার্মা, আরাকান, কক্সবাজা, পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতি এলাকা হতে আগত মানুষের প্রধান অঞ্চলগুলো পরিদৃষ্টে চন্দনাইশে মলঙ্গি ছাড়া অন্যকোনো গোষ্ঠীর বিদ্যমানতা সহজে ধরা পড়ত না। কারণ অন্যান্য গোষ্ঠীর লোকজন কৃষিকাজ, পশুপালন কিংবা ভূ-ভিত্তিক বিভিন্ন কাজে প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করত। ইতিহাসবেত্তাদের অনেকে মলঙ্গি গোষ্ঠীভুক্ত লোকদেরকে কিরাতদেরই একটি উন্নত উপগোষ্ঠী বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ আবার মলঙ্গিদেরকে আর্যদের একটি নি¤œ-শ্রেনির গোত্র বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর্যরা ব্যবসায় উপলক্ষে চন্দনাইশ  আসার সময় ব্যবসায়ীদের সাথে আগত মলঙ্গিরা চন্দনাইশে ধীরে ধীরে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। তারা ছিল আর্য বণিকদের শ্রমিক-কর্মী। আর্য-মলঙ্গিরা বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চল হতে ব্যবসায়িক সহায়তাকারী হিসাবে হালিয়াদাশদের কয়েক বছর আগে খ্রিস্ট পূর্ব ৩য়-৪র্থ অব্দে চন্দনাইশে বসতি গড়ে তোলেছিল। মলঙ্গিদের উৎসাহ এবং আহবানে হালিয়াদাশেরা মলঙ্গিদেরই হাত ধরে চন্দনাইশ পাড়ি জমিয়েছিল। এরা চন্দনাইশ য় আসার কয়েক বছর পর হালিয়াদাশেরা চন্দনাইশ আসে এবং প্রথমবারের মতো পরিকল্পিত উপায়ে চাষাবাস শুরু করে। এর পূর্ব পর্যন্ত চন্দনাইশে চাষাবাদ করা হলেও পরিকল্পিত উপায়ে কৃষিকাজ করার মতো কোনো জ্ঞান তাদের ছিল না।  প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলাদি আহরণ করত। 
সম্পদ সংগ্রহ, আধিপত্য বিস্তার ও মতাদর্শ বা ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অব্দের মধ্যে আর্যরা গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন জনপদসমূহে রাজ্য বিস্তার ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা শুরু করে বলে ঐতিহাসিক বিশ্লেষকদের ধারণা। খ্রিস্ট পূর্ব ১২০০ অব্দের পূর্বে আর্যরা পঞ্চনদ অতিক্রম করে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এ পর্যায়ে তারা চন্দনাইশ  পর্যন্ত আগমন করেছিল। সুদূর পোল্যান্ড হতে আর্যদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল বলে ইতিহাসবেত্তাদের অভিমত।  চন্দনাইশের ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আর্যরা জ্ঞাত থাকলেও জলপথে যোগাযোগের পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং কৌশলগত প্রযুক্তি অপর্যাপ্ত হওয়ায় দীর্ঘকাল তারা চন্দনাইশে সরাসরি শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করা হতে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ৫ম অব্দের দিকে একটি মারাত্মক ভূমিক¤প এবং অন্যবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সমুদ্র ও গঙ্গা নদী  শুকিয়ে বা ভরাট হয়ে শীর্ণকায় হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আর্যরা কিরাত অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং আধিপত্য গড়ে তোলে। 
১০ম খ্রিস্টাব্দের দিকে সমুদ্র দক্ষিণ ও পূর্বদিকে সরে আসায় কিরাত এবং আর্য অঞ্চলের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। এসময় চন্দনাইশে আর্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। অযোধ্যা হতে রামের প্রপিতামহ রঘু সমতট অঞ্চলে সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন বলে জানা যায়। ওই অভিযান বঙ্গোপসাগরের প্রান্ত পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে পিলিœর পেরিপ্লাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য ÒA tour of conquest of India by Roughu, the great grandfather of Ram, starting from Auyodna he went eastward to ocean having conquered Bangalis.” 
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, চন্দনাইশের ইতিহাস,  দ্বিতীয় অধ্যায়।
এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। এ লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় ও চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন