অনেকদিন‘আহমদ হোসেন বীরপ্রতীকের জবানিতে ঠাকুগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি পেয়েছি হলো। পড়ার সুযোগ করতে পারছিলাম না বলে লিখতে পারিনি। এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছি। এমন একটি বৃহৎ বই পাঠানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব বেশি লেখাপড়া আমার নেই। গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, রিপোর্ট, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদি- যা কিছু পড়েছি বা দেখেছি তা যেন সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারছিল না। আমার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের যে চিহ্ন, যে আবহ, যে গন্ধ, যে রোদ, যে উত্তাপ তা সম্পূর্ণরূপে কোনো লেখায়, বইয়ে, চলচ্চিত্রে পাচ্ছিলাম না। নয় মাসে এত বড় যুদ্ধ কীভাবে শেষ হয়ে গেল, কারা যুদ্ধ করেছিল, যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের মূল ভিত্তিটা কোথায় ছিল- এসব বিষয় এতদিন অস্পষ্টই ছিল। ‘ঠাকুর গাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি পড়ার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারণা গড়ে নিতে পারি। এই বই থেকেই হতে পারে মহৎ একটি চলচ্চিত্র কিংবা আরও অনেক সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম। তানভীর মোকাম্মেল পেলে এ বই নিয়ে চলচ্চিত্র বানাবেন কিনা আমার জানা নেই। তবে সময় পেলে এবং ঠাকুরগাঁও যাবার সুযোগ হলে ‘চিত্রনাট্য’ লেখার ইচ্ছা আছে।ভূমিকা পড়ে জানা যায়, আহমদ হোসেন বীরপ্রতীকের যুদ্ধকালীন ডায়েরির ছায়াবলম্বনে বইটি লেখা হয়েছে।তাই এটি একটি বাস্তবতার নিরিখে লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ।
জীবনেরবইটিতে ভালো লাগার অনেক লাইন আছে। কোথাও চোখে জল এসেছে, কোথাও শিউরে উঠতে হয়েছে অজানা শঙ্কায়।যে সকল বাক্য সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তার কিছু উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না - “ যেখানে জীবন নেই সেখানে আবার ভয় কী! জীবনহীন জীবনের মতো অকুতোভয় বাঙালি জোয়ানেরা দিনাজুপর সেক্টর লণ্ড ভণ্ড করে দেয়।” চারিদিকে নিকষ অন্ধকার- - - কোথাও আলো নেই। যেন ভৌতিক সিনেমার সুটিং হচ্ছে। ---- এ পরিস্থিতিতে এক মিনিট সময় নষ্ট করা এক বছরের চেয়েও ভয়ঙ্কর।--- চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, নিজের শরীরের অস্তিত্বও অনুভব করা যাচ্ছে না।”-- এমন মুগ্ধর অসংখ্য লাইন। চতুর্থ অধ্যায় এককথায় অনবদ্য, অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য বর্ণনায় ঠাসা। পুরো অধ্যয় যেন, একটি স্বপ্নের অবিনাশী ঘোর। আমাকে অভিভূত করে রাখে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এমন মগ্ন খুব কমই বইতে হতে পেরেছি। এ অধ্যায়ে পাকিস্তানি মেজর ও তার পরিবারের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। মেজরের নয় মাসের একটি বাচ্চাকে মেঝেতে ছুড়ে মারা হয়েছে। যুদ্ধের এমন ভয়ঙ্কর অথচ মানবিক বর্ণনা আর কোনো লেখায় পাইনি। অসাধারণ এ অধ্যায় বইটাকে ক্ল্যাসিক্যাল মর্যাদা দান করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। এতবড় অধ্যায় তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখানে লেখলাম না। তুমি লেখক, তবু আবার পড়ে নিও। নিজেই শিউরে উঠবে যুদ্ধের পাশবতায়।বইয়ের প্রতিটি লাইনই যেন অনিবার্য, প্রতিটি শব্দই অবিচ্ছেদ্য। কবিতার মতো একটি লাইনও কোথাও হতে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। বাদ দিলে ছন্দ থাকবে না যেন।
আরও কিছু লাইন আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ যেমন “- - - তাঁর বাংলোর সবকটি দরজা ও জানালায় ফোর্স আনাগোনা করছে। --- আমরা দেশের জন্য লড়ব, কিচ্ছু লাগবে না স্যার, হাতপা-ই যথেষ্ট। --- আমি তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিই। --- ক্লান্তির পরশে সবাই মুহূর্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়, আমার চোখে ঘুম নেই। সবই যেন তাদের ভাবনাগুলো আমাকে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। --- বুকের ভেতর এখনও কুকুরের ডাক, পাশের পাড়ার কুকুরের শব্দ এখন আমার বুকে। --- ” এসব লাইন একেবারে কবিতার মতো। বইয়ের ঘটনা, ঘটনার বর্ণনা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা এবং যুদ্ধের যে ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা দিয়েছে- তা এ বইটি না পড়লে কখনও পেতাম কিনা সন্দেহ। আমার মতে, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত একটি অসাধারণ গ্রন্থ। যেখানে যুদ্ধ, জয়পরাজয় ও যুদ্ধের ভয়াবহতার উভয় পিঠকে বাস্তবতার আলোকে নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।বইটির প্রচ্ছদ ও গেট আপ দুটোই চমৎকার। কিছু প্রিন্টিং মিসটেক আছে, তবে খুবই সামান্য। ‘হতে’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, আমার হিসাবমতে সত্তর বারের বেশি। এটি বইয়ের পঠনে কিছুটা ছন্দপতন এনেছে। এছাড়া আর সব ঠিক, একদম যেখানে যা প্রয়োজন। ‘হতে’ ও ‘থেকে’ শব্দুটির ব্যবহার পরবর্তী সংস্করণে পুনঃবিবেচনা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের উপর এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতায় যোজিত ব্যতিক্রমধর্মী ও অসাধারণ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য জানাই অভিনন্দন, ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন