রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

ভেদরগঞ্জ উপজেলা ও ইনিয়নসমূহের নামকরণ বিচিত্রা / ড. মোহাম্মদ আমীন


আয়তন ও জনসংখ্যা বিবেচনায় ভেদরগঞ্জ শরীয়তপুর জেলার বৃহত্তম উপজেলা। ১৩ টি ইউনিয়ন, ১ টি পৌরসভা ও ২টি প্রশাসনিক থানা সমন্বয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রশাসনিক অবয়ব রচিত। শরীয়তপুর জেলা সদর হতে ১২ কিলোমিটার পুর্বে ভেদরগঞ্জ উপজেলা সদর অবস্থিত। ভৌগলিক বিবেচনায় ২৩.৩৮ ডিগ্রি হতে ২৩.২৪ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ও ১০.২৩ ডিগ্রি হতে ১০.৩৬ ডিগ্রি পুর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যšত ভেদরগঞ্জ জেলা বি¯তৃত। ২৬৭.২৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তরে নড়িয়া উপজেলা, মুন্সিগঞ্জ জেলা ও পদ্মা নদী, দক্ষিণে ডামুড্যা ও গোসাইর হাট উপজেলা, পুর্বে চাঁদপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে শরীয়তপুর সদর ও নড়িয়া উপজেলা অবস্থিত। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আদম শুমারি অনুযায়ী ভেদরগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২,৩৭,৭৮০, তৎমধ্যে পুরুষ ও মহিলা যথাক্রমে ১২০৯৬০ ও ১১৬৮২০। ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৩৬৮ টি গ্রামে মোট খানার সংখ্যা ৪৬৮২০। শিক্ষিতের হার ৪০.৪৭ ভাগ। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর ভেদরগঞ্জ উপজেলায় উন্নীত হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ মানোন্নীত উপজেলা উদ্বোধন করেন। মোহাম্মদ খালিদ আনোয়ার ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যšত ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ২১ বছরে ভারপ্রাপ্তসহ মোট ১৮ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। উত্তর তারাবুনিয়ার আনোয়ার হোসেন মাঝি ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রথম ও একমাত্র উপজেলা চেয়ারম্যান। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ্ধাতি বাতিল হওয়ার পুর্ব পর্যšত তিনি ভেদরগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভেদরগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ভেদরগঞ্জ থানায় এবং ৯টি সখিপুর থানায় অবস্থিত। রামভদ্রপুর, মহিষার, ছয়গাঁও, নারায়নপুর ভেদরগঞ্জ থানায় এবং ডিএমখালী, চরকুমারিয়া, সখিপুর, চরসেনসাস, আরশিনগর, চরভাগা, কাঁচিকাটা, উত্তর তারাবুনিয়া, দক্ষিণ তারাবুনিয়া সখিপুর থানায় অবস্থিত।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বিক্রমপুর পরগনার জমিদার সৈয়দ ভেদার উদ্দিন শাহের প্রয়াসে ভেদরগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভেদরগঞ্জ এলাকা ছিল ভেদার উদ্দিনের জমিদারির অংশবিশেষ। তখন এর কিয়দংশ নারায়নপুর, কিয়দংশ কার্তিকপুর নামে পরিচিত ছিল। ভেদার উদ্দিন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এখানে সফরে আসেন। এলাকার প্রজাসাধারণ আইন-শৃঙখলা ও জন নিরাপত্তার স্বার্থে একটি থানা স্থাপনের দাবি জানান। এলাকাটি তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার হিসেবে খ্যাত ছিল। ছয়গাঁওসহ ভেদরগঞ্জের প্রায় প্রতিটি গ্রামে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রচন্ড ঢেউ। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের দমনের জন্য এখানে একটি থানা স্থাপনের জন্য উদগ্রীব ছিল। অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। ভেদার উদ্দিন শাহ প্রজাদের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকারের নিকট এখানে একটি থানা স্থাপনের আবেদন পেশ করেন। ভেদার উদ্দিনের মত একজন বিত্তবান জমিদারের আবেদন ব্রিটিশ সরকারের উৎসাহে অনুকূল প্রবাহ সৃষ্টি করে। একটি অত্যাবশ্যক প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার সুযোগ পায় সরকার। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বৃটিশ সরকার এলাকাটিকে থানা ঘোষণা করে। জমিদার সৈয়দ ভেদার উদ্দিন শাহের নামানুসারে থানাটি ভেদরগঞ্জ নামে পরিচিত লাভ করে। ভেদরগঞ্জের নামকরণের পেছনে আরও একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে। এর একটি ‘কাদা প্রাবদ’ নামে পরিচিত। ভেদার শব্দের অর্থ কাদা। এক সময় এ এলাকায় প্রচুর কাদা ছিল, কাদার জন্য মানুষের হাটা-চলা ছিল দুষ্কর। লোকজনকে বহুকষ্টে কাদা (ভেদার) মাড়িয়ে গঞ্জে আসতে হত। তাই এলাকাটি ভেদরগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। অনেকের মতে এখানে প্রচুর বেদে ছিল। নদীর পাড়ে সবসময় অসংখ্য বেদে বহর থাকত। তাই এলাকাটির নাম ভেদরগঞ্জ হয়েছে। আধুনিক গবেষণায় প্রবাদ দুটি নিছক প্রবাদ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মুলত ভেদার শাহের নাম হতে ভেদরগঞ্জ নামের উৎপত্তি। 
ভেদরগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়ন ও গ্রামসমুহের নামের বৈশিষ্ট্য যেমন আকর্ষণীয় তেমনি ব্যতিক্রমী। প্রত্যেকটি নামকরণ স্বকীয় ঐতিহ্যে মন্ডিত ঐতিহাসিক প্রবারণার একটি গুরুত্বপুর্ণ ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিটি নামের পেছনে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের রেনু রেনু স্বর্ণ আর ঋদ্ধ মানুষের কর্মময় জীবনের গুচছ গুচছ চিত্র। প্রতিটি নাম যেন এক একটি জীবন্ত ইতিহাস। এ উপজেলার অধিকাংশ স্থানের নামের পরে উপসর্গের ন্যায় কিছু সাধারণ স্বর যুক্ত। কাটি, কান্দি, পুর, চর, কুড়ি, নগর, গাঁও, হাটি, পট্টি, সার, খালি, কুয়া, ভোগ, খোলা, কর ইত্যাদি স্বরগুচছ উপসর্গের মত অধিকাংশ স্থানের নামের আগে-পাছে জুড়ে। কোন কোন গ্রামে আবার মুল নামের পুর্বেও এ ধরণের স্বরগুচছ বসানো হয়েছে। আবার কিছু কিছু নাম রয়েছে স¤পুর্ণ ব্যতিক্রম। উদাহরণ স্বরূপ পুর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের ‘ভয়রাগ জারিয়া’ গ্রামের কথা উল্লেখ করা যায়। জনৈক ব্যক্তির নেতৃত্বে কিছু যুবক ভয়-রাগ জারিয়া (জেরে) বহিরাগত সন্ত্রাসীদের কবল হতে এলাকাটি পুনরায় দখল করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল বলে এলাকাটির নাম হয় ‘ভয়রাগ জারিয়া’। শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা, গোসাইরহাট, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর সদর, জাজিরা ও নড়িয়াসহ মাদারীপুর জেলার কিয়দংশ মিলে একটি প্রশাসনিক এলাকা ছিল। তখন এ অংশটি নারায়নপুর নামে পরিচিত ছিল। এখনও শরীয়তপুর জেলার প্রায় প্রত্যেকটি উপজেলায় কোন না কোনভাবে নারায়নপুর নামের গ্রাম রয়েছে। পুর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের চর নারায়নপুর, রুদ্রকর ইউনিয়নের চর লক্ষিনারায়ন, জপসার লক্ষিপুর, ভেদরগঞ্জের নারায়নপুর ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
চিতলিয়া ইউনিয়নের কাশিপুর একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। হিন্দুপাড়ার বিপরীতে মুসলমানেরা গ্রামের নাম রেখেছে কাশিপুর মুসলিম পাড়া। মাহমুদপুর ইউনিয়নের নাম ছিল হরিপুর। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে মোগল শাসনামলের স্বর্ণযুগে কিছু মুসলমান মাহমুদপুর নাম দিয়ে একটি নতুন গ্রামের গোড়া পত্তন করে। মুসলমানদের কর্মকান্ডের বিপরীতে সেখানকার নায়েব রামা আনন্দ সহকারে তার ছেলে বিনোদের নামে বিনোদপুর গড়ে তোলে। গ্রামের কিছু অংশ দেবতার নামে হাওলা করে দেয়া হয়। রাম আনন্দ করে হাওলা করেছে বলে প্রজাগণ এলাকাটির নাম রাখেন রামানন্দ হাওলা। দারুল আমান নায়েব রাম রায়ের অধিনে ছিল। তিনি ওখানে একটি গ্রাম করেছিলেন। গ্রামটির নাম রামরায়ের কান্দি। নড়িয়া পৌরসভার মুলপাড়া, নিকড়ি পাড়া, গোয়ালপাড়া ও পাইকপাড়ার বিপরীতে মুসলমানেরা গড়ে তোলে মুসলিম পাড়া, মল্লিকপাড়া, ভুইয়া পাড়া, খলিফা পাড়া ইত্যাদি গ্রাম। 
বাকি অংশ

সূত্র : ভেদরগঞ্জের ইতিহাস,  প্রথম অধ্যায়, নামকরণ বিচিত্রা, লেখক : ড. মোহাম্মদ আমীন।

[ প্রকাশক বা লেখকের অনুমতি ব্যতীত এর কোনো অংশ বা অংশবিশেষ অন্য কোথাও সূত্রবিহীনভাবে ব্যবহার চৌর্যবৃত্তি বলে গণ্য করা হবে।]

গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, মাতৃভাষা জ্ঞান, প্রাত্যহিক প্রয়োজন, শুদ্ধ বানান চর্চা এবং বিসিএস-সহ যে-কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি লিংক :
শুবাচ লিংক
শুবাচ লিংক/২
শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/১
শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/২
শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/৩
নাটোর জেলার নামকরণ
চকরিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণ ও ঐতিহ্য
হাতিয়া উপজেলার নামকরণ ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পটুয়াখালী আগুনমুখা নদীর নামকরণ

1 টি মন্তব্য:

  1. ভেদরগঞ্জ এর ইতিহাস বইটি প্রকাশনার বিষয়ে আমি সহযোগীতা করেছিলাম।

    উত্তরমুছুন