শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (সপ্তম পর্ব) / ড. মোহাম্মদ আমীন



ব্যবসা, দস্যুতা এবং অবারিত শোষণের লক্ষ্যে পরিচালিত শাসনের নামে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত  পর্তুগিজরা চন্দনাইশে মগদের সঙ্গে মিলে ‘হার্মাদ মুলুক’ কায়েম করে পুরো চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামকে অত্যাচারের জাহান্নামরূপে গড়ে আতঙ্কিত রাজ্যে পরিণত করেছিল। আরাকানিরা পর্তুগিজদের মাধ্যমে তঁাঁদের জলদস্যুতা প্রসারের লক্ষ্যে পর্তুগিজদেরকে উপকূলবর্তী এলাকায় জায়গাজমি দিয়ে
উৎসাহিত করত। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহু আরাকানি মগ পর্তুগিজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমন্বিত দস্যুতা পরিচালনা করার জন্য চন্দনাইশের নদীসংলগ্ন এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গড়ে তুলেছিল। দোহাজারী, চক্রশালা, বৈলতলী, ধোপাছড়ি, কাঞ্চনগরের পাহাড় প্রভৃতি এলাকায় আরাকান ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের স্থলঘাটি ছিল। বিশেষ করে শঙ্খ নদীর এপাড়া ও পাড়ের অবস্থিত দুটি ঘাটি ছিল সবচেয়ে কুখ্যাত। অস্ত্রের দাপটে পর্তুগিজরা নির্বিচারে শতশত মহিলাকে জোরপূর্বক বিয়ে কিংবা ধর্ষণ করত। তৎকালে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা এলাকাবাসীর জানা না থাকায় প্রচুর আরাকান এবং পর্তুগিজ রক্তবাহিত মানুষ চন্দনাইশে জন্ম নেয়। 
একপর্যায়ে রাজনীতিক কারণে বাংলার সুলতানের সঙ্গে চন্দনাইশের মগশাসিত এলাকার সখ্যতা গড়ে উঠে। সে সুবাদে বহু  মুসলিম চন্দনাইশ আসা যাওয়া শুরু করে। চন্দনাইশের সাথে বার্মার যোগাযোগ এবং কুটনীতিক স¤পর্ক ১৪০০ খৃস্টাব্দ হতে সুমধুর ছিল। এসময় চন্দনাইশ এলাকার বহুলোক বার্মা ও রেঙ্গুনে যেত। চট্টগ্রাম বহু আঞ্চলিক গানে রেঙ্গন-চট্টগ্রাম সুসম্পর্কের কথা ভেসে ওঠে। সে সূত্রে বার্মিজ রক্তও চন্দনাইশবাসীর রক্তের সঙ্গে মিশে চন্দনাইশে অভিনব সংকারায়ন জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। বহু চন্দনাইশবাসী বার্মায় গিয়ে সেখানকার মেয়ে বিয়ে করেও নিয়ে আসত। অন্যদিকে, একথা অনস্বীকার্য যে, কিরাতদের মাধ্যমে চন্দনাইশে ভোট-চীনা রক্তের প্রবাহ  অনস্বীকার্যভাবে আদিকাল হতে চলে আসছিল। 
অতীতে সমতলে রাঢ়া, সুহ্মা, পুন্ড্রা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর লোকেরা পুরো বঙ্গদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। নৃবিজ্ঞানীদের বিশ্বাস এরা অষ্ট্রো-মঙ্গোলাইড এবং অষ্ট্রিক-ভেড্ডিড-আলপীয় হতে পারে। তা যদি হয় তো বঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত নিষাদ, কোল, ভীল, মু-া, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ মালপাহাড়ি, ওরাঙ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর লোক আদি অস্ট্রাল বা অস্ট্রেলীয় কিংবা ভেড্ডিড গোত্রের বলে গবেষকদের বিশ্বাস। গবেষকদের বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট  ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণযোগ্য- একথাও নিঃসন্দেহে বলা যায়। অন্যদিকে মেচ, মিজো, কুখি, চাকমা, মারমা, আরকানি, বনযোগি, লুসাই, উসুই, মুরং, নাগা, কোচ, রাজবংশি, কিরাত, চাক, তঞ্চাঙ্গা, আরকানি প্রভৃতি সন্দেহাতীতভাবে মঙ্গোলীয়, যারা আজ হতে ৫০০ বছর আগেও চন্দনাইশের মুল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এবং তারাই নিয়ন্ত্রণ করত চন্দনাইশসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম। কালের পরিক্রমায় তার নবাগতদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে দূর্গম এলাকায় চলে যায়। (ক্রমশ:)

  সূত্র. মোহাম্মদ আমীনচন্দনাইশের ইতিহাস,  দ্বিতীয় অধ্যায়
[ এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন