শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

চন্দনাইশ Chandanaish এর জনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (পঞ্চম পর্ব) / ড. মোহাম্মদআমীন

১৪৬ খ্রিস্টাব্দ হতে চন্দনাইশে মানব বসতির ইতিহাসের আধুনিক পর্যায় শুরু হয়। ১৪৬ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকানের প্রথম রাজা মাগধী চন্দ্র সূর্যের অভিযানে অংশগ্রহণকারী মগধাগত হিন্দু-বৌদ্ধ সৈনিকদের সংশিশ্রণে চন্দনাইশের নি¤œবর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধ অধিবাসীর উৎপত্তি ঘটে। তখন হতে চন্দনাইশে মানব বসতির ইতিহাসে আধুনিক পর্যায়ের শুরু হয়। কিরাত, মলঙ্গি এবং হালিয়াদাশদের পর বার্মা, নেপাল, তিব্বত, চীনাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকাসমূহ হতে মগ, টিপরা, রেরুয়া, আহমা ও নাট প্রভৃতি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর লোকেরা এলাকাভিত্তিক বসতি গড়ে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য ভূখ- হতে আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক ও প্রাকৃতিক কারণে অনেক অধিবাসী চন্দনাইশে এসে স্থায়ী ও অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলতে শুরু করে। নব্য-বসতি স্থাপনকারীরা তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের সহযোগিতায় এলাকার আদি বসতিদের প্রাধান্য ক্ষুণœ করে নিজেরাই কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং প্রভাব বলয় বিস্তার করে আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।  অনেকে নবাগতদের ভয়ে সমতল এলাকা ছেড়ে ধোপাছড়িসহ পার্বত্য এলাকায় চলে যায়। 
নবাগতরা সহিংস নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে আদিবাসীদের সরিয়ে উর্বর এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক স্থানসমূহ নিজেরা দখল করে নিতে শুরু করে। বাধা দিতে এসে সহজ সরল আদিবাসীরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও কুট-বুদ্ধিস¤পন্ন নবাগতদের কাছে পরাজিত হতে থাকে। ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো অনৈক্য এবং নেতৃত্বের অভাবে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নবাগতদের নিকট প্রচ-ভাবে হেরে যায়। আদি বাসিন্দারা ক্রমশ তাদের প্রাধান্য হারিয়ে ফেলতে থাকে। নব্য ও আদিবাসী উভয়ের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব এবং তীব্র প্রতিযোগিতায় আদিবাসীরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আদিবাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য দূর্গম এলাকায় চলে যায়। অন্যদিকে মলঙ্গিসহ অনেক অবস্থাপন্ন আদিবাসী ক্রমশ এলাকার মূলস্রোত ধারার সঙ্গে মিশে যায়। 
এ ভাবে চন্দনাইশের উপজাতিরা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের শূন্য জায়গা পূর্ণ হয়ে উঠে দ্রুত। অন্যান্য এলাকা হতে আগত  লোকেরা আরবীয় পর্যটকদের সহযোগিতায় এখানে নিজস্ব স্বকীয়তাময় পরিম-ল গড়ে  তোলে। এখন চন্দনাইশের কোথাও হালিয়াদাস বা মলঙ্গি কিংবা অন্যকোনো নামের আদিম অধিবাসীর অস্তিত্ব দেখা যায় না, যেমন দেখা যায় উত্তর বঙ্গের উপকূলীয় এলাকাগুলোয়।  যদিও বর্তমান অধিবাসীর অনেকে তাদের উত্তরপুরুষ। বর্তমানে চন্দনাইশের অধিবাসীরা চট্টগ্রাম, ভুলুয়া, দাঁদারা, সন্দ্বীপ, বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ, বিক্রমপুর, ত্রিপুরা, শাহবাজপুর, পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতি এলাকা হতে চন্দনাইশে এসে বসাতি গড়ে  তোলেছিল। চন্দনাইশের সমৃদ্ধি ও বিশাল ভূ-ভাগের সাথে সাথে প্রাকৃতিক স¤পদের প্রাচুর্য্য যুগে যুগে মানুষকে আকর্ষণ করেছে সীমাহীন টানে।
মহাভারতেও আর্য যুগের প্রারম্ভে এতৎঞ্চলের দ্বীপ এবং উপকূলীয় ভূখ-সমূহের গুরুত্ব ও ভূমিকার কথা উল্লেখ আছে। তৎবিশ্লেষণে চন্দনাইশ  উপকূলে খ্রিস্টপূর্ব সময় হতে আর্যদের আগমন ও প্রভাব স¤পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। দ্বিগবিজয়ী পা-ববীর ভীম পূর্বাঞ্চলীয় নরপতিদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বিরাট অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। অভিযান সফলকাম হওয়ায় সংগতকারণে চন্দনাইশসহ পাশ্ববর্তী সংলগ্ন এলাকায় আর্য প্রভাব আরও সুসংহত হয়ে ওঠে। জনশ্রুতিমতে, পা-ববীর ভীম অভিযান পরিচালনা করে পুরো চন্দনাইশ  করায়ত্ত করে নিয়েছিলেন। চক্রশালা ও বরমায় পা-ববীর কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে ভীম চন্দনাইশে আর্য প্রভাব স্থায়িত্ব করার বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নেননি। চন্দনাইশের অনার্যরা সহজে আর্য প্রভাব ও সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ায় মহাবীর ভীম এখানকার অনার্যদের প্রতি দয়াদ্র ছিলেন। বিদ্রোহী অনার্যদের তিনি চন্দনাইশ  হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা ভীমের ভয়ে বান্দরবান ও চকরিয়াসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। একটি দল চলে গিয়েছিল সুদূর আরাকান। তবে হিন্দু আর্য নেতা মহারাজ দ্রুহ্য-এর কিরাত জয়ের পরপরই চন্দনাইশ এলাকাসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম  সরাসরি আর্য প্রভাবের স্থায়িত্বের সূচনা ঘটে। দ্রুহ্য ও  ত্বদীয় অব্যবহিত অধস্তন ত্রিলোচন এবং শেষদিকে ৭৫-তম অধস্তন কিরীট (প্রকাশ ডূংগুর ফ্রা কিংবা ফ্রাঁ) পার্বত্য ত্রিপুরায় অবস্থান করে প্রতিনিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে চন্দনাইশ অঞ্চল শাসন করতেন।  চক্রশালা ছিল তাঁর আঞ্চলিক প্রশাসকের প্রধান দপ্তর।
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, চন্দনাইশের ইতিহাস,  দ্বিতীয় অধ্যায়।
এটি লেখকের নিজস্ব গবেষণা। এ লেখা বা এর অংশবিশেষ লেখক বা প্রকাশকের বিনানুমতিতে অন্য কোথাও ব্যবহার আইনগতভাবে দণ্ডনীয়, অশোভনীয় ও চৌর্যবৃত্তি গণ্য করা হবে। এমন কেউ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আশা করি কোনো ভদ্র, বিবেকবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এমন চৌর্যবৃত্তি হতে বিরত থাকবেন। তবু যদি কেউ এমন করেন তাহলে লেখাসমূহ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন